হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ কি
Table of Contents
চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রসারের আরেক নাম হাইপারটেনশন

সারাবিশ্বে প্রায় ১৫০০ মিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। বাংলাদেশে ২৫ শতাংশ মানুষ হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। আর তাতে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি এই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগছেন।
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়?
পূর্বে ভাবা হত কেবল বয়স্ক মানুষেরা উচ্চরক্তচাপে ভুগে থাকেন কিন্তু সম্প্রতি অল্পবয়সীদের মধ্যেও এ রোগ আগের তুলনায় বেশি দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ হাইপারটেনশনে ভুগছেন সে সম্পর্কে জানেন না অথবা জানার চেষ্টাই করেনা অথবা এই বিষয়ে তেমন সচেতন নন।
ফলাফল, দিনের পর দিন হার্ট অ্যাটাক বা হার্ট ফেইলিওরের মত বড় রোগে আক্রান্ত হন পরে। যদি কিছুটা সচেতন হন,নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে হাইপারটেনশনের হাত থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া সম্ভব অথবা ক্ষতি যা হওয়ার তা কমানো সম্ভব। তাই নিয়মিত ৬ মাস পরপর অন্তত দুই হাতেরই রক্তচাপ দেখা উচিৎ এবং বছরে অন্তত একবার রেজিস্টার্ড চিকিৎসক (এমবিবিএস ডিগ্রি সম্পন্ন) দিয়ে রক্তচাপ বা ব্লাডপ্রেশার চেক করা উচিত।
আরও পড়ুন: উচ্চরক্তচাপ পরিমাপের নিয়ম
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ কী?
সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের কোন লক্ষন থাকেনা, তবে নিম্নের লক্ষন গুলো অনেকের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ যখন কোন কমপ্লিকেশন করে তখন সাধারণত লক্ষন দেখা যায়।
- ঘাড় ও মাথা ব্যথার সাথে মাথা ঘোরা থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে
- অল্পে রেগে যাওয়া বা অস্থির লাগা
- রাতে ভালো ঘুম না হওয়া বা ইনসোমনিয়া
- বুকে ব্যাথা, বুকে চিন চিন করে ব্যাথা
- কাজ করার সময় হাপিয়ে যাওয়া
ইত্যাদি লক্ষন থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ বুঝবেন কিভাবে?
হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে (রক্ত নালি) রক্ত প্রবাহের চাপ সবসময় বেশি থাকলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলা হয়। কোন খারাপ লাগলে অবশ্যই রক্তচাপ মাপবেন, ২০ বছর পার হলে, কোন সমস্যা না থাকলেও অন্তত একবার রক্তচাপ দেখুন, পরবর্তীতে বছরে অন্তত একবার করে চেক করবেন। রক্তচাপ পরিমাপের দুটি একক, সিস্টলিক প্রেশার, যাকে উপরের প্রেশার এবং ডায়াস্টলিক প্রেশার, যাকে নিচের দিকের প্রেশার বলা হয়, সেখানে নির্ধারিত মাত্রার উপরে রক্তচাপ চলে যায়। রক্তচাপ ১২০/৮০ এর মধ্যে থাকাকে স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ১২০/৮০ মি.মি.মার্কারি এর বেশি অথবা সিস্টোলিক ১২০ মি.মি.মার্কারি এর বেশি অথবা সিস্টোলিক ৯০মি.মি.মার্কারি এর বেশি। তবে সেটি যদি কারো সবসময় ১৪০/৯০ এর বেশি থাকলে তখন সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বলে চিহ্নিত করা হয়। বয়সের তারতম্যের ভিত্তিতে রক্তচাপের কিছুটা তারতম্য বিদ্যমান।
রক্তচাপ এর কারণ? উচ্চরক্তচাপ কেন হয়?
উচ্চ রক্তচাপ কি কারণে হয় নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ কারনই অজানা। ৫ থেকে ১০ ভাগ রোগীর বিভিন্ন রোগ (কিডনি জটিলতা, রক্তনালি সরু হয়ে যাওয়া, হরমোনাল সমস্যা, ঔষধের সাইড ইফেক্ট, ইত্যাদি) কারণে উচ্চরক্তচাপ হয়ে থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ থেকে কী জটিলতা হতে পারে–
নিরবঘাতক অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৯৪ লাখ মানুষ মারা যান। উচ্চ রক্তচাপের কারণে শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ থেকে স্ট্রোক হতে পারে, যা থেকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে (যাকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলা হয়)। এরকম ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপের কারণে হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপের কারণে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনার উপায়
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনার প্রধান ২টি উপায়
১ লাইফস্টাইল মডিফিকেশন
২ ঔষধের সাহায্য নেওয়া।
সঠিকভাবে লাইফস্টাইল মডিফিকেশনে ৫০-৬০% রোগীর অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, আর অবশিষ্টদের লাইফস্টাইল মডিফিকেশন এর পাশাপাশি ঔষধ গ্রহণ করতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
লাইফস্টাইল এ সেসব পরিবর্তন আনবেন উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে-
- খাবারে আলগা লবণ বা লবন জাতীয় খাবার কম খেতে হবে।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, অতিরিক্ত ওজন থাকলে কমাতে হবে।
- শাক-সবজি, ফলমূল বেশি করে খেতে হবে, রেড মিট (গরু ও খাসির মাংস ইত্যাদি) পরিহার করা উত্তম, তবে মুরগীর মাংস, মাছ ইত্যাদি খাওয়া যাবে।
- ডিমের কুসুম এবং দুধের সর ইত্যাদি পরিহার করা উত্তম।
- নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করতে হবে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট।
- নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করতে হবে এবং চিকিৎসকের ফলোয়াপে থাকতে হবে।
- ডায়বেটিস থাকলে সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
- তামাক ও তামাক জাতীয় বস্তু গ্রহনের অভ্যাস থাকলে তা বাদ দিতে হবে
- প্রতিদিন নিয়মিত ৭/৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে।
- দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ কমাতে হবে
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা যাবে না
আরও পড়ুন:
- উচ্চরক্তচাপ পরিমাপের নিয়ম
- জ্বর কি, কেন হয় এবং জ্বর হলে করণীয় কি?
- কোন রোগের কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রংপুর জেলা
- কোন রোগে কোন ঔষধ খাবেন ও কি করণীয়
হাই ব্লাড-প্রেসারের চিকিৎসায় কি কি ঔষধ ব্যবহার করা হয়?
উচ্চ রক্তচাপ কমানোর বিভিন্ন ধরনের ঔষধ রয়েছে, বিভিন্ন রোগীদের বিভিন্ন ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টি-হাইপারটেন্সিভ মেডিসিন নিবেন। বাড়ির পাশের দোকানের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন, প্রয়োজনে উপজেলা কমপ্লেক্স এ জান ১০ টাকায় টিকেট কেটে এমবিবিএস ডিগ্রি সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ এ নিমোক্ত গ্রুপের বিভিন্ন ঔষধ দেওয়া হয়।
- ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (এমলোডিপিন)
- বিটা ব্লকার(এটেনোলোল, বিসোপ্রোলোল, মেটোপ্রোলল ইত্যাদি)
- এসিই ইনহিবিটর (রেমিপ্রিল, লিসিনোপরিল, পেরিন্ডোপরিল।ইত্যাদি)
- এআরবি (লোসারটান, অলমেসারটান, টেলমিসারটান ইত্যাদি)
- আল্ফা ব্লকার (প্রাজোসিন ইত্যাদি)
- ডাইইউরেটিকস (থায়াজাইড, ফ্রুসেমাইডই ইত্যাদি) মেডিসিন ব্যবহার করা হয়।
উপরোক্ত তালিকা ছাড়াও আরো কিছু উচ্চ রক্তচাপ এর ঔষধ রয়েছে, পরে এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখব।

লেখক:
ডাঃ মোঃ নোমান ইসলাম নিরব
এমবিবিএস, ডিএমইউ, এমএসসি(নিট্রিশন – অন কোর্স)
সিনিয়র মেডিকেল অফিসার, হাইপারটেনশন রিসার্চ সেন্টার, রংপুর
Pingback: উচ্চরক্তচাপ পরিমাপের নিয়ম — Doctors Gang